শহুরে জীবন ছেড়ে গ্রামীণ পরিবেশে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা
প্রকাশ: বুধবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:২৯ পিএম
|
![]() পড়াশুনা শেষ করে শহর ছেড়ে গ্রামে আসার পরে শহুরে ও গ্রামীণ জীবনের মাঝে বিশেষ পার্থক্য অনুভূত হয়।গ্রামের নির্মল প্রকৃতি ও এ গ্রামীণ জীবনে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন মানিকগঞ্জের শিবালয়ে অবস্থিত রাওয়ান ইবনে রমজার স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক মো. সাখাওয়াত হোসেন। চাকরিতে নতুন যোগদান করেছি মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয়ের এক গ্রামে।এখানে আছি এক মাস হতে চলেছে। নতুন জায়গা। মনটা আর টিকছে না।প্রথম দিকে ভেবেছিলাম যে, নতুন জায়গায় এসেছি তাই হয়তো মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিছুদিন থাকার পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু না, তা আর হচ্ছে না।এখানে আসার পর থেকেই মনটা শুধু সারাক্ষণ পালাই পালাই করছে। শহরে থাকতে থাকতে মনটা একদম বিষিয়ে উঠেছিল।মূলত জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে শহরে। তাই নিজেই খুবকরে চাচ্ছিলাম, যেনো নিয়োগটা কোনো গ্রামীণ এলাকায় হয়।কিন্তু এখানে এসে দেখি পরিবার ছাড়া থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।একদম ছন্নছাড়া হয়ে গেছি।পড়াশোনা করছি না,ঠিকভাবে খাওয়া দাওয়া হচ্ছে না।জামাকাপড় ধোয়া হচ্ছে না।এক জামা পড়ে এক মাস কাটিয়ে দিলাম। খুব অগোছালো অবস্থা। চাকরিতে একদম নতুন যোগদান করেছি।তাই ট্রেনিং এবং নানান ঝামেলায় নতুন এ গ্রামটাও এতোদিন ঘুরে দেখা হয়ে ওঠেনি।দু'দিন সাপ্তাহিক ছুটি পেলাম।রুমে একা বসে আছি।সময় আর যাচ্ছে না।দুপুর বেলা। মনও ভালো লাগছে না।ভাবলাম, গ্রামটা একটু ঘুরে দেখি। হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম। আসলে প্রচন্ডরকম সুন্দর একটা গ্রাম।পাশ দিয়ে বিশাল পদ্মা নদী বয়ে গেছে।উপজেলা শহর থেকে নদীর গা ঘেঁষে এঁকেবেঁকে রাস্তা চলে গেছে অন্য গ্রামে।রাস্তার দুপাশে ছোট বড় গাছ চারপাশটা আরও নিরব এবং ঠান্ডা করে দিয়েছে।যাইহোক ভর দুপুর। কাকগুলো ডাকছে।এখনো রাস্তা ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছি। দেখা যাক, কোথায় শেষ হয় এ গ্রাম। মাঠে নানা ধরনের ফসল হয়ে আছে।আলু গাছ, ভুট্টা, গম, পেঁয়াজ এবং সরিষা ফুলে ভরে আছে পুরো মাঠ। সারি সারি খেজুর গাছ।তাতে রসের হাঁড়ি পাতছে গাছি।পাখিরা ঘুরে ঘুরে এ গাছ থেকে ও গাছে গিয়ে রস খাচ্ছে।বিভিন্ন ধরনের পাখি।হলুদ রঙের পাখিগুলো অনেক বছর পরে দেখতে পেলাম।ছোট বেলায় এ পাখি আমার প্রিয় পাখি ছিলো।নাম জানতাম না, তাই হলদে পাখি বলেই ডাকতাম। বিকেল হয়েছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য অস্ত যাবে।পশ্চিম দিগন্তে গোধূলি আভা সূর্যকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।এখনও গ্রামের মধ্য দিয়ে হাঁটছি আর চারপাশটা খুব উপভোগ করছি। সন্ধ্যা নেমে গেছে, ছেলে-মেয়েরা খেলা শেষ করে বাড়িতে ফিরছে। দূরের কোন এক মসজিদ থেকে আজান শোনা যাচ্ছে।হারিয়ে গেলাম শৈশবের স্মৃতিতে। ছোট বেলায় দুপুরে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে না ঘুমিয়ে হাঁটতে বেড়িয়ে পড়ার কথা মনে পড়ে গেলো।মনটা হুহু করে উঠলো।মনে পড়ছে,মাগরিবের আজান হলে এমনকরেই খেলা শেষে খুব দ্রুত চলে এসে পড়তে বসে যেতাম। আহা! সময় জীবন থেকে কতো দ্রুত চলে যায়। পারিপার্শ্বিকতা এবং সমাজ বাস্তবতার চাহিদা জীবন থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে সেই দিনগুলো।সবকিছু আগের মতোই আছে,তবে হাতে সেই সময় নেই।বয়স বেড়েছে, সেই মন নেই। মা আছেন, কিন্তু মা এখন আর পড়তে বসতে বলেন না। আজ অনেক বছর পরে কৈশোরের সেই গ্রামের কথা, গ্রামের পাশে মাঠ,রাস্তা,সরিষা ক্ষেত, সারি সারি খেজুর গাছে রসের হাঁড়ি; এ সকল দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো। এইতো সেদিনের কথা। আমাদের গ্রামেও শীত এলে গাছে গাছে রসের হাঁড়ি ঝুলতো।সেসময় নিয়মকরে মা রসের পিঠার আয়োজন করতেন।মা পিঠা ভালো বানাতে পারতেন না, তাই ফুপু বেড়াতে আসলে পিঠা হতো। ভাই-বোন সবাই একসঙ্গে বসে আনন্দ করে খেতাম।মাঠে মাঠে সরিষার ফুল ফুটে থাকতো।এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতাম,ফুল ছিঁড়তাম। বাবার চাকরির সুবাদে শৈশব থেকে এ পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় কেটেছে বিভিন্ন শহরে।তবে এর মাঝে কৈশোরের বেশ কয়েক বছর অবশ্য নিজ গ্রামে থেকেছিলাম।খুব আনন্দে কেটেছিল দিনগুলো। যদিও এখন আর সেই গ্রাম নেই। বছর খানেক আগের কথা। শীতের মধ্যে গ্রামে গিয়েছিলাম।সেই আগের ঐতিহ্য আর চোখে পড়লো না। খেজুর গাছ নেই।গাছে গাছে সেই রসের হাঁড়ি নেই।সরিষা ক্ষেত নেই।গ্রামটি এখন পৌরসভা হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে এটি শহর হতে চলেছে।আগের সেই খেলার মাঠগুলো নেই। ছেলে-মেয়েরাও সেই চিরচেনা খেলাগুলো এখন আর খেলছে না।তারা মোবাইল স্ক্রিনে ডুবে আছে, গেম খেলছে। তাদের কাছে আমাদের সময়ের খেলাগুলো ভালো লাগে না। বিশ্বায়ন হয়েছে।সর্বত্র আধুনিককতার ছোঁয়া লেগেছে।আমাদের অভ্যাস,স্বাদ,ভালো লাগা সবকিছুর মধ্যেই এক অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন এসেছে। মোঃ সাখাওয়াত হোসেন শিক্ষক,রাওয়ান ইবনে রমজান স্কুল এন্ড কলেজ, শিবালয়, মানিকগঞ্জ। |